Naim Al Tahsin / Sweet Memories


Sweet Memories


Australia 

 ক্লাস নাইন-টেনের কথা বলছি। মুদ্রা সংগ্রহে উদ্দীপনা তখন তুঙ্গে। ততোদিনে চারিপাশে সকল পরিচিত বা বন্ধু মহলের কাছে প্রচার হয়ে গেছে এই ব্যক্তি ভীনদেশী কয়েন সংগ্রহ করে। আমি মুখের লাজ বিসর্জন দিয়ে খুঁজে বেড়াতাম এগুলো। লাজ বলাটা যৌক্তিক হবেনা বোধহয়। আসলে সংগ্রহের ব্যাপারে লাজ শব্দটা অভিধানে তখনো যোগ হয়নি। মানে, কারো কাছে মুদ্রা আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে মান যাবে সে চিন্তা মাথাতেই আসেনি। আমি তখনো প্রতিদিন সকালে মক্তবে যাই। আমার সাথে পড়তো রূপক। ও মসজিদের এলাকার বাসিন্দা। ও একদিন ওদের বাসার পাশের আল-আমিন নামের এক ছেলের কথা বললো যে, তার কাছে নাকি একটা বড় পয়সা আছে। বিক্রি করবে। বড় পয়সা শুনেই ভালো লাগতো। কিন্তু কেউ বেচবে বললে মন ছোট হয়ে যেতো, কারণ সামর্থ্যের দিক দিয়ে আমি দূর্বল।
আল-আমিনকে আমি মুখ চেনা চিনতাম, কিন্তু ভালো পরিচিত  ছিলোনা। রুপকের মাধ্যমে খবর পাঠালাম আমি মুদ্রাটা দেখতে চাই। একদিন মসজিদের পাশে আল-আমিন এসে আমাকে ডাক দিলে আমি গিয়ে দেখি এই অস্ট্রেলিয়ার ৫০ সেন্টের কয়েনটি। আমি এর আগে এতো বড় পয়সা দেখিনি কখনো। চোখ লকলক করছিলো। জিজ্ঞেস করলাম, কত টাকায় বিক্রি করতে চাও। 
- বিশ টাকা।
আমি নেহাতই দূর্বল, এতো দাম দিয়ে কয়েন কখনো কিনিনি আগে। আমার সর্বোচ্চ বাজেট থাকতো ৫ টাকা। সেখানে ২০ টাকা চাইছে???!!! 
কিন্তু ভালবাসা কমাতে পারিনি। আমি সাহস করে ১৫ টাকা বলে দিয়েছিলাম, যদিওবা জানতাম না কিভাবে এই টাকাটা জোগাড় করবো। 
কিন্তু আল-আমিন দেয়নি।
বেশ তদবির করেছিলাম, রুপকের কাছে আফসোস ও প্রকাশ করেছিলাম। অনেক পরে গিয়ে একদিন আল-আমিনের হাতের এই অস্ট্রেলিয়ান কয়েনটি আমি নিতে সমর্থ্য হই। তবে বিশ টাকা দিয়েই। এবং আমি অনেক খুশি ছিলাম এতো বড় কয়েন পেয়ে।

Bangladesh
সময়টা সঠিকভাবে মনে নেই। নাইন-টেনের কথা হবে। মুদ্রা সংগ্রহে শান দেয়া চলছে তখন। যাকেই পাচ্ছি জিজ্ঞেস করছি, আছে নাকি কিছু? 
নোয়াখালী পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে থাকি সে সময়। বাসার পাশে এক সেন্ট্রি পোস্টে একজন TRC (Trainee Recruit Constable) ডিউটি করছিলেন। উনারা যেহেতু, একা একা ডিউটি করতে করতে বিরক্তবোধ করতেন। তাই কোনো ছোট কাউকে পেলে আগ্রহ নিয়ে কথা বলতেন। সে হিসেবে উনার সাথে আমার দারুণ সখ্যতা গড়ে উঠে ওই এক আলাপেই। তারপর আমিও স্বভাব বশত বলে বসলাম, আপনার কাছে কি কোনো বিদেশি পয়সা আছে?? 
অবাক করে দিয়ে উনি বললেন আছে। তবে দেশি পয়সা। 
উনি উনার মানিব্যাগ বের করলেন এবং তার কোণ থেকে এই ১ পয়সার কয়েনটি হাতে নিয়ে আমাকে দেখালেন। আমি ত পুরাই থ!!! 
সে সময় যখন আমার কাছে ১০/২০ টা কয়েনও সংগ্রহে নেই, তখনকার দিনে এই ১ পয়সার কয়েনটি আমার কাছে কোহিনূরের চেয়ে কম ছিলনা। আমার শখের কথা এবং আবেগপ্রবণতা দেখে তিনি আমাকে মুদ্রাটি উপহার দিয়ে দিলেন। আমিও বলেছি যে, এটিকে আমি আপনার চেয়েও বেশি সযত্নে রাখবো।
প্রায় ১ যুগ পর, আজও রয়েছে মুদ্রাটি। একটি স্মৃতি হিসেবে।

Canada - Front

Canada - Back
হাইস্কুল জীবনে মসজিদে গিয়ে তারাবীর নামাজ পড়াটা অনেক বেশি স্মৃতিতে লেগে আছে। ট্রেনিং করতে আসা লোকজনদের উপস্থিতিতেই ভরপুর থাকতো মসজিদ। পাশের অন্য অংশে আমরা এবং এলাকাবাসিরা নামাজ আদায় করতাম। সব বন্ধুরা মিলে এক সাথেই দাড়াতাম। রুকুতে যাওয়ার সময় দৌড়ে গিয়ে নামাজ ধরতাম। এখন বুঝতে পারি, এটা উচিৎ হয়নি।
একদিন দিগন্ত নামের পাশের এলাকার এক সংগ্রাহক বন্ধু একটি পয়সা নিয়ে এলো আমাকে দেখাবে বলে। খুব সম্ভবতঃ ওর খালা হবেন, যিনি সম্প্রতি ক্যানাডা থেকে পাঠিয়েছেন কিছু মুদ্রা। আমি কল্পনা প্রবণ মানুষ হিসেবে মুদ্রাটিতে কল্পনার উপজীব্য খুঁজে পাই। পাহাড়ের পাশে বিশাল সাগর, আর সাগরের মাঝে ডলফিন মাছ ছুটোছুটি করছে। কেমন একটা ফ্যান্টাসিতে ভুগছিলাম। খুবই পছন্দ হয়েছে মুদ্রাটি। আরো দারুণ বিষয় তার একপাশে লেখা রয়েছে British Columbia. তার মানে এটা কি কলাম্বিয়ার মুদ্রা?! অবিশ্বাস্য!
কিন্তু অন্য পাশে আবার ক্যানাডা লেখা কেনো? ক্যানাডার নাম অনেক শুনেছি, আর সে দেশে অনেক মানুষই যায়, কিন্তু কলম্বিয়ার নাম কম শুনেছি আর বাংলাদেশ থেকে আদৌ কি কেউ ওখানে যায়? না, যায়না।
তার মানে ক্যানাডা থেকে কলম্বিয়া হলো কঠিন দেশের মুদ্রা। কিন্তু পয়সায় ক্যানাডা কেন লেখা আছে, এই দুঃখে সে সময় থাকতে পারছিলাম না। আমার ক্যানাডার কয়েন চাইনা, আমার কলম্বিয়ার চাই। 
একদিন দিগন্তের কাছ থেকে অন্য মুদ্রার বিনিময়ে অনেক কষ্টে অদলবদল করে নিলাম মুদ্রাটি।
তবে নিজের মনকে কোনো ভাবেই মানাতে পারছিলাম না যে এটা ক্যানাডার পয়সা। ক্যানাডা নামটি দেখলেই আমার গা জ্বালা শুরু করতো। তাই একদিন করলাম কি, লোহার পেরেক দিয়ে ঘষে ঘষে ক্যানাডা নামটি তোলার চেষ্টা করছিলাম। যেনো এটা কলম্বিয়ার মুদ্রা হিসেবে পরিচিতি পায়। 
কি এক দূর্দান্ত আবেগ ছিলো সে সময়। আজ ও কয়েনের মাঝে দাগটি দেখতে পেলে হো হো করে হাসি আর স্মৃতিচারণ করি।

Greece
সুধারাম থানা পুকুরের উত্তর পাড়ে বড় বট গাছ ছিলো।  তার পাতাগুলো পুকুরের কিনারায় ঝড়ে পড়লে  পাতার তলে টাকি মাছ, বাইল্লা মাছের লুকিয়ে থাকা বাচ্চা গুলো দুই হাত দিয়ে ঘেরাও করে ধরে ধরে হরলিক্সের কাঁচের বয়ামে ভরে পড়ার টেবিলে রাখতাম।
আমাদের এলাকার ছেলে-পুলেদের একেকবার একেক শখ জাগতো। সেবারে জেগেছিলো কাঁচের বয়ামে মাছ পালার ঝোঁক। তবে সেজন্য শিং মাছের বাচ্চার কদর ছিল বেশি আমাদের কাছে। পিচঢালা রাস্তার ছিঁটকে পড়া পাথর কুড়িয়ে সাথে দু-চারটে শিং মাছের পোনা বোয়ামে ভরে রাখলে যা দারুণ লাগতো-না!!!
পাশের বাসার শয়ন এসেছে একটা পয়সা নিয়ে, ও স্কুল থেকে কালেক্ট করেছে। কি দারুণ দেখতে কয়েনটা। সোনার মতো! কিন্তু কোন দেশ তা জানতাম না। 20 euro cents লেখা। এতো যে ভালো লেগেছিলো পয়সাটি। কিন্তু শয়ন তো দিচ্ছে না। 
কি করার, কি করার ভাবতে ভাবতে টের পেলাম শয়নেরও শখ জেগেছে শিং মাছে বাচ্চা বয়ামে রাখার। কিন্তু শিং মাছের বাচ্চা পাওয়া বেশ কঠিন ছিলো আমাদের জন্য। পুরনো ডাবের খোসা পেতে ধরতে হতো সেই পোনা।
এই সুযোগে আমি তাকে অফার করলাম মাছের বিনিময়ে কয়েন দিতে। সে রাজি হলো। এবং আমি পেলাম দুটো শিং মাছের বিনিময়ে গ্রিসের এই কয়েনটি৷

Solomon Islands
সংগ্রহের শুরুর অল্প কাল বাদেই "কঠিন দেশ" নামক শব্দের ভুত ভর করে মাথায়। কে কতো রেয়ার কয়েন পেতে পারি। ইংলিশ ডিকশিনারি ভেতর থাকা বিভিন্ন দেশের নাম ও পতাকা দেখতাম। যে দেশটি বাংলাদেশ থেকে দূরে হবে সেটিই কঠিন দেশের মুদ্রা! এমন একটি কয়েন পাওয়া মানে বন্ধু মহলে আমার একটা মর্যাদা তৈরী হওয়া। সবাই নিতে চাইবে সেটা। এমনকি দু-তিনটে কয়েনের বিপরীতেও হোক না কেনো। এ তো বিশাল ব্যাপার। 
ভর দুপুর বেলা। আধা-নির্মিত বিল্ডিংয়ের নিচে বসে শুকোতে দেওয়া গম মুরগীর খাওয়া থেকে রক্ষা করছিলাম। দূরে দেখছি সাদা স্কুলের পোষাকে একটি ছেলে কোনো একটা পয়সা নিয়ে টস করতে করতে আসছে। ওর নাম ইমন। অত্যন্ত ভালো এবং ভদ্র ছেলে। তবে বেচারার কিডনির অসুখ ছিলো। বয়সে হবে আমার দুই বছরের জুনিয়র। 
কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, ইমন এটা কিসের পয়সা? 
ও কাছে এসে আমাকে পয়সাটি হাতে দিলো।
Solomon Islands?!
অবিশ্বাস্য! আরে!!! এ দেশে কি বাংলাদেশের মানুষ যায়? এ দেশের নাম ও ত শুনা যায়না। শুনেছি দেশটি সাগরে বিলীন হয়ে যাবে?? 
কতশত প্রশ্ন মনে আর উত্তেজনা!!
- ইমন, পয়সাটা আমাকে দিবা?
- ফাহাদ ভাই, আপনার জন্যই এনেছি।
আমি ইমনের কথা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি আনন্দে চিৎকার করবো নাকি?
জিজ্ঞেস করলাম, কত টাকা দিবো ইমন? 
- ভাইয়া ৫ টাকা দিলেই হবে। আমার বন্ধুর কাছ থেকে কিনেছি। 
আমি বললাম ঠিক আছে। তাই দিবো। 
ইমন বলছিলো আরেকটি মোটা কয়েন নাকি ওর আরেকজন বন্ধুর কাছে নাকি বিক্রি করে এসেছে আজ। ওটা শ্রীলঙ্কার। 
হাতের দু-আংগুল দিয়ে দেখালো, এত্তো মোটা ফাহাদ ভাই।
বললাম কতো টাকায় বিক্রি করেছো? 
- ৫ টাকা।
- আমি তোমাকে ৬ টাকা দেবো ইমন। তুমি যেভাবেই হোক আমাকে ঐ কয়েনটা এনে দাও। আমার একটা দেশ বাড়বে তাহলে। 
ও বললো, আমি চেষ্টা করবো ভাইয়া।

 Sri Lanka - Back 

 Sri Lanka - Edge 


 Sri Lanka - front

 বিছানার বালিশের কাছে রেখে দিয়েছিলাম Solomon Islands এর কয়েনটি। রাতে ঘুমানোর আগ অবধি উল্টেপাল্টে দেখতাম এটিকে। পয়সাটি ময়লা বিধায় এক সংগ্রাহক বন্ধু বলেছিলো পরিষ্কার করে দেবে। কিন্তু ও জানায় পয়সাটি হারিয়ে গেছে। আমার কলিজায় পানি ছিলোনা। অবশেষে একদিন খুঁজে পেয়ে আমাকে স্বস্তি দিলো সে। 
মনে মনে ভীষণ অপেক্ষা করছিলাম  শ্রীলঙ্কার সেই মোটা কয়েনের। আহা! কি দারুণই না দেখতে হবে সেটি।
আর হ্যাঁ তখন জানতাম না যে, পয়সাটিকে মোটা পয়সা - মোটা পয়সা না বলে, একে আমি পুরুত্ব বিশিষ্ট পয়সা ও বলতে পারতাম।
যাইহোক, সলোমন আইল্যান্ডের মুদ্রা পাবার এক বা দুদিন বাদে ইমন খেলার মাঠে নিয়ে আসে শ্রীলঙ্কার পয়সাটি। আহা! কি সুন্দর। সোনালি রঙের। ওজনেও খাসা। সৌন্দর্যটাই যেনো অন্য রকম। একপাশে কাটা দাগ। তাতে কি? চাঁদেরও দাগ আছে। চাকার মতো ছুড়তাম, দাড় করানোর চেষ্টা করতাম। এতো পুরুত্বের কয়েন আমার আর ছিলোনা তখন। সে কয়েনটি নিয়ে যেতাম টস করতে খেলার মাঠে। সবাই হা করে তাকিয়ে থাকতো। 
মনে মনে ভাবতাম, ইমন কতই না ভালো ছেলে। আমার জন্য এতো কিছু করেছে সে।
২০১০ সালে বিদায় নেই নোয়াখালী থেকে। কিন্তু বছর খানেক বাদে স্কুলের কাজে আবারো গিয়েছিলাম আমাদের সেই এলাকায়, পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে। গিয়েই ইমনকে খোঁজা শুরু করলাম। ট্রান্সফার হয়ে হয়ে যায়নি ত আংকেল? নানা প্রশ্ন মনে। আবেগ ভালোবাসা আর মধুর স্মৃতি চারণ করছিলাম আমার এলাকার। পুরনো একজনের দেখা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই ইমন কোথায়? বাসায় নাকি স্কুলে?
কিন্তু তার উত্তরটি ছিলো, ইমন ত মারা গেছে!
তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি ইমন আমার সাথে আছে, এই মুদ্রাতে আমি ইমনকে খুঁজে পাই।


 GO BACK TO HOME PAGE



6 comments:

  1. Actually this is best way of collection. I have more than 500 Coins (100+ Countries) in my collection. And believe it or not I have collected these (not purchased!!) from my relatives and friends.

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  3. লেখাটা পড়ে অনেক ভালো লাগল! সেই ছোটবেলার কথা গুলো মনে পড়ল; ৯০ এর দশক, যখন আমি coin সংগ্রহ শুরু করেছিলাম...

    ReplyDelete
  4. লেখাগুলো এতো যে অসাধারণ হয়েছে 😍😍 সংগ্রহের মজা এখানেই 😍কি যে ভালো লাগে যখন এই ধরনের স্মৃতি জুড়ে থাকে। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে কানাডার কয়েনের গল্পটা,

    ReplyDelete
  5. সংগ্রহের গল্পগুলো মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো, আমিও নোয়াখালীর সংগ্রাহক, আমাদের যোগাযোগ হতে পারে কি?

    ReplyDelete